না থাকতে চাওয়ার ইচ্ছেটা মুখ ফুটে বলতে না পারার সাহস যার থাকেনা, সে কত'টা অসহায়ত্ব বোধ করে অবসরে, এটা ভাবলেই এক ধরনের চাপা চিৎকারের শব্দ কানে ভেসে আসে।
মাঝে মাঝে এমন কি হয়না, একসাথে থাকার ইচ্ছেটা মরে যায়?
এটা সবার হয়না, আমার হয়। একসময় খুব হতো। আমি যেহেতু সবাই নই, তাই নিজের এই মুক্তির পিপাসায় কাতর হওয়ার গল্পটা তো একটু বলাই যায়।
এমন প্রায়ই হয়েছে যে, একসাথে বহুদিন থাকার পর হঠাত করে মনে হয়েছে যে আমার আর এই মানুষটার সাথে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।
এই যে একসাথে সারাজীবন থাকার ইচ্ছাটা যখন মরে যায়, তখন চাইলেই কাউকে ছেড়ে চলে আসা যায়না। সম্পর্কের একটা দায়বদ্ধতা থাকে। সেই দায়বদ্ধতায় আটকে যাওয়ার বহু গল্প, বহু জীবন, বহু হতাশা আমি দেখেছি।
প্রেম ততোক্ষন পর্যন্ত সুন্দর, যতক্ষন এটা গঠন হতে থাকে, যতক্ষন এটা নির্মানাধীন অবস্থায় থাকে। সমস্ত প্রেম নির্মানকার্য সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন।
সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হলেও মানুষ একেবারে হুট করে নাই হয়ে যেতে পারেনা। নির্মানাধীন অবস্থায় মুহূর্তগুলোকে রূপ রস দেওয়ার জন্য যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাকে, সেসবকে তুচ্ছ করে চলে যাওয়া যায়না। মানুষ প্রতারণা করতে চাইলেও সরাসরি প্রতারক হওয়াকে এড়িয়ে চলে।
মাঝে মাঝে খুব এমন হয় যে, মানুষটার অনুপস্থিতিতে দমবন্ধ লাগে। কখনো কখনো এমনও হয় যে মানুষটার সবসময়ের উপস্থিতিতেও দমবন্ধ লাগে।
যত্নহীনতায় যেমন নিজেকে অসহায় মনে হয়, কখনো কখনো খুব যত্নেও অক্সিজেনের অভাববোধ হয়ে উঠে। ভালোবাসা ভালোবাসা টাইপ মোহটা কেটে যাওয়ার পর, মানুষ যখন টের পায় তার নিজের সাথে নিজের যোগাযোগ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, তখন মুক্তি চায় গোপনে। এই মুক্তির ইচ্ছাটা কাউকে বলা যায়না। কাউকে বলা যায়না এর কারন হলো মানুষ মুখে থুঃ থুঃ মেরে দিবে। একটা কমন কথা আছে, একসাথে থাকতে ইচ্ছে হবেনা তাহলে ভালোবেসেছিলো কেন? একসাথে থাকতে ইচ্ছে হবেনা, এটা আগে মনে ছিল না?
আমি বেশ অবাক হই, কারন এই ইচ্ছেদের মরে যাওয়াতে নিজের কোন হাত থাকেনা। এটা হয়ে যায় মাঝে মাঝে৷ নাকি কারোই এমন হয়না? আমি যেহেতু পবিত্র মানুষ নই, আমার তো প্রায়ই হয়। এই সত্য স্বীকার করে নিতে আমি একটুও কেপে উঠি না। বরং আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি তখন, যখন প্রেমের কম্পন থেমে গিয়ে আমি নিথর হয়ে বসে থাকি অবসরের চেয়ারে।
কোনকিছু ছেড়ে আসার ইচ্ছেটা যদি একবার বুকের ভেতর বাসা বেঁধে ফেলে, সেই জিনিসটা একসময় আর থাকেনা।
ছেড়ে আসতে হয়না, কিছু কিছু জিনিস এমনিতেই ছুটে চলে যায় অযত্নে অথবা অপ্রকাশিত অবহেলায়।
একসাথে থাকতে হলে, দুটো হাতই শক্ত করে ধরে রাখতে হয়। একটি হাত আলগা হয়ে গেলে, শত চেষ্টাতেও অপর হাতটি সেই আলগা হয়ে যাওয়া হাতটাকে আগলে রাখতে পারেনা। বিপরীত মানুষের অনাগ্রহে এই মানুষটা একসময় ছুটে চলে যেতে বাধ্য হয়।
চলে যাওয়ার কালে একজন হয়তো কষ্ট পায়, তবুও এখানে থাকে আনন্দ।
এই আনন্দ মুক্তির আনন্দ। অনেক দিনের দাসত্ব থেকে মুক্তির আনন্দকে মানুষ অস্বীকার করতে পারেনা। যদিও এই মুক্তিতে গান গাইতে ইচ্ছে হয়না, নাঁচতে ইচ্ছে হয়না, তবুও এই আনন্দে মরে যাওয়া কোষ সতেজ হয়ে উঠে।
আমি যা লিখছি, তা কেবলই প্রতারকদের সাফাই গাওয়া মনে হতে পারে। তবে, আমার চিন্তাটা আলাদা। আমি যেহেতু সবাই নই, তাই আমার চিন্তা করার ক্ষমতাটাও সবার চেয়ে আলাদাই হবে।
আমি একজন প্রতারকের প্রতারক হয়ে উঠার পেছনের গল্প হিসেবে বুঝি মুক্তির আর্তনাদ।
খাঁচা থেকে বেরুবার এক গোপন চিৎকার। নিয়মের বাইরে এসে নিজেকে খুঁজে বেরানো। নিজের সাথে নিজের যোগাযোগহীনতাকে কমিয়ে আনার এক প্রবল আগ্রহ।
খুব যত্নে বেঁচে থাকাটা একটা দাসত্বের মতো। দাসত্ব যত সুন্দরই হোক না, সেই সুন্দর একসময় গলার কাটার মতো হয়ে যায়।
সবার হয়তো হয়না, আমার হয়। কারন, আমি সবাই নই। আমি আমার।
নিজের একটা গল্প বলি। নিজের গল্প লিখতেই বেশি ভালো লাগে। এখানে জীবনের গোপন অপরাধবোধের দায়মুক্তি ঘটে।
আমি লিখে লিখে নিজেকে হালকা করি। যে কথা কাউকে বলা যায়না, সে কথা অবলিলায় লিখে ফেলা যায় কাগজে কলমে।
মানুষকে ছেড়ে আসার একটা অপরাধবোধ ভেতরে থাকেই। বাইরে থেকে যাকে আমরা প্রতারকদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করে রাখি, সে আসলে তার নিজের কাছে অত'টা প্রতারক নয়। মানুষ প্রতারণা করে নিজের জন্য। যখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তখনই মানুষ মুক্তি খুঁজে। প্রতিটা মানুষের চলে যাওয়ার পেছনেই কিছুনা কিছু লজিক থাকে। এক পক্ষের কাছে যেটা প্রয়োজন, অপর পক্ষের কাছে সেটাই হয়ে উঠে প্রতারণা।
আমি একসময় যাকে ঠকিয়ে চলে এসেছিলাম, তার সাথে যদি রয়ে যেতাম তাহলে সবসময় নিজেকে ঠকে যেতে হতো। মানুষ তো তার নিজের চেয়ে বেশি কাউকে ভালোবাসতে পারেনা। কখনো কখনো মানুষ প্রতারক হয়ে উঠে বাঁচার জন্য। ঘর ভর্তি প্রেমই শুধু সুখী করতে পারেনা, মাঝে মাঝে দুঃখ কষ্ট নিঃসঙ্গতাও প্রয়োজন হয়ে উঠে।
কয়েক বছর আগে এক আষাঢ়ের রাতে যার সাথে দুঃখী দুঃখী জীবনের গল্প বলতে বলতে ভালোবেসেছিলাম, একসময় তার প্রতিই প্রবল অনাগ্রহ কাজ করেছে।
কেউ আমার জীবনের দুঃখ কষ্টের গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনছে, এই ব্যপারটা তার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। একটা মায়া তৈরী করে ফেলে। মানুষটাকে আশ্রয় মনে হয়। মনে হয়, সমস্ত রাত মুখ গুঁজে বসে থাকি বুকে। এই মায়াটাকে আমি ভালোবাসা বলিনা। ভালোবাসা ব্যপারটা আলাদা। এটার ডেফিনেশন দু এক লাইন লিখে প্রকাশ করা যায়না।
সাময়িক মোহ থেকেই আমরা একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে যাই। মোহ ক্ষনস্থায়ী ব্যপার। এর রেশ যেকোন সময় ডাইভার্ট হয়ে যেতে পারে।
প্রচন্ড মোহগ্রস্থ হয়ে যার সাথে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছিলাম, যার যত্নকে অলংকার বানিয়ে গলায় ঝুলিয়েছিলাম, সেই অলংকার একসময় শেকল হয়ে উঠেছিলো। প্রেম ততোক্ষনই মুগ্ধ করে, যতক্ষন এটা সহজ এবং সরল পথে চলে৷ ঠিক যখন থেকে জীবনে সীমাবদ্ধতা চলে আসে, তখন এটা গলার কাটার মতো হয়ে যায়।
কাটা গলা থেকে বের করতে না পারার একটা যন্ত্রনা আছে। এটা শান্তি দেয়না। সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা বলতে আমি বুঝি, নিজের জীবনের প্রতি অন্য কারো একনায়কতান্ত্রিক আচরনকে। এটাতে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হয়। নিজের যে স্বভাবের জন্য নিজেকে ভালোবেসে এসেছি দিনের পর দিন, কেউ এসে সেই অভ্যাসকে জোর করে বদলাতে চাইলেই সেটা শেকল হয়ে যায়।
যে আমাকে দেখে কেউ ভালোবাসে, সে যদি আমাকে তার মতো বানানোর চেষ্টা করতে শুরু করে, তবে ভালোবাসেনি কখনো।
আমি আমিই। আমি সে না। আমি কেউ না। আমি কারো মতো না।
আমি চাইনা, কেউই আমার মতো হোক। আমি চাইনা, আমি কারো মতো হই।
আমি চাই, সে আমাকে ভালোবাসুক, যে আমিটাই সত্যি। যে আমিটাই ন্যাচারাল।
আমি কারো কাছে প্রতারক হওয়া মানে নিজের কাছে প্রতারক নই।
আমি জোর করে কারো কাছে পবিত্র এবং উপযুক্ত হতে চাইলে, নিজের কাছে প্রতারক হয়ে থাকবো জীবনের শেষ শ্বাস পর্যন্ত।
নিজের কাছে নিজেই প্রতারক হওয়া গল্পের নায়কদের তালিকায় আমি নেই। আমি আমার মতো, কারো মনের মতো নই। কারো মনের মতো হবোনা কখনো।

Comments

Popular posts from this blog