আমাদের গ্রামে একটা প্রচলিত নিয়ম হলো, বিয়ের পর মেয়েদের নাকফুল পরতে হয়। সদ্য বিয়ে হওয়া কোন মেয়ে যদি নাকফুল হারিয়ে ফেলে, তবে তার স্বামী এবং সংসার নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার গুজব রটতে থাকে প্রতিবেশি আন্টিদের মুখে।
এই ব্যপারটা আমি ছোটবেলা থেকেই খুব মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করি। আমি খেয়াল করি, মানুষ ভবিষ্যত কি সহজেই অনুমান করে ফেলে সামান্য নাকফুল হারিয়ে যাওয়ার সিম্পল উপাত্তের উপর নির্ভর করে।
একটা নাকফুল যে সম্পর্ককে সবসময় টিকিয়ে রাখতে পারেনা, এটা টের পেলাম যখন আমি কলেজে পড়ি। সেসময় আমার একজন মেয়ে বন্ধু ছিল। বয়সে আমার চেয়ে একটু বড়ই হবে হয়তো। সে ক্লাস টেইন থেকে নাকফুল পরে। নাকফুল তার একটা শখ। মেয়েটাকে বেশ সুন্দরী দেখায় নাকফুলে। শুভ্র শাদা চামড়ার উপর জ্বলজ্বল করা একটা পাথরের নাকফুল, তাকে যেন অপ্সরী বানিয়ে রাখে।
তার বিয়ে হওয়ার কয়েক মাস পরেই বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিচ্ছেদ মানে একেবারেই ডিভোর্স। বিয়েহীন সম্পর্কের বিচ্ছেদে মানুষটার ফিরে আসার একটা probability বেঁচে থাকে। ওই সাময়িক আলাদা হওয়াকে আমরা যত্ন করে নাম দিয়েছি ব্রেকাপ। বিয়ের পর যে বিচ্ছেদ, ওটাকে আর ব্রেকাপ বলা যায়না। বিয়ের পরের বিচ্ছেদ মানে ডিভোর্স। যেখানে মানুষের ফিরে আসার পসিবিলিটি শূন্যের ঘরে চলে আসে। ফিরলে হয়তো ফেরা যায়, তবে রুচি থাকেনা। আগ্রহ থাকেনা। আকর্ষন থাকেনা।
যাইহোক, আমার সেই মেয়ে বন্ধুর নাম নুসরাত। তার ডিভোর্স হওয়ার পর আমি তাকে বললাম "আচ্ছা, তুই কখনো নাকফুল হারিয়েছিলি?"
সে জিজ্ঞেস করলো- কেন রে? এই কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
আমি তোতলাতে তোতলাতে জবাব দিলাম- নাহ কিছুনা, এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। অনেকে বলে, নাকফুল হারালে সংসার টিকে না।
নুসরাত হাসতে হাসতে বললো- নাকফুল হারালে কিছু যায় আসেনা, বিশ্বাস হারালে সবই চলে যায়। নাকফুলের অভাবে সংসার চলতে সমস্যা হয়না, বিশ্বাসের অভাব হলে কি করে একসাথে থাকে মানুষ!
এই জায়গাটা থেকে আমি একটা জিনিস নোট করে রেখেছি; বিশ্বাস!
জগতে শুদ্ধ বিশ্বাসের বড্ড অভাব। I trust you more than myself বলা যত সহজ, বিশ্বাস করাটা ততো সহজ বিষয় না।
বিশ্বাসের ভিত্তিটা একটু একটু করে গড়ে উঠে। একটা দেয়ালের মতন। একটা একটা করে ইট এবং তার ফাকে ফাকে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে আটকাতে আটকাতে একসময় বিশাল ইমারতের সৃষ্টি হয়। বিশ্বাসকে আমি বলি দেয়াল। যে দেয়ালের সৃষ্টিতে ছোট ছোট অনেক কারন থাকে।
দুদিনের প্রেমেই যে আমাকে বলে- তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না? কিংবা যে বলে " আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি!"
আমি তাদের মেধার অপরিপক্কতায় প্রচন্ড মুগ্ধ হওয়ার বিপরীত কিছু একটা হই।
বিশ্বাস ব্যপারটা এত ঠুনকো কোন বিষয় না। বড় অট্টালিকা বানানোর আগে যেমন সয়েল টেস্ট করতে হয়, বিশ্বাস করার আগেও এরকম কিছু পরীক্ষা করে নেওয়া লাগে।
তাকে আমার ভালো লাগে, তাকালেই মরে যেতে ইচ্ছে হয়, আঙুল ধরার বাসনা কাজ করে, চোখ বন্ধ করলেই কামনা জাগে কিংবা একসাথে সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন বুনতে ভালো লাগে মানেই আমি তাকে বিশ্বাস করি ব্যপারটা এমন নয়।
আমি কাউকে বিশ্বাস করার আগে ভাবি, সে আমার জন্য কতটুকু ত্যাগ করেছে। যে আমার জন্য তার জীবনের মূল্যবান কিছু ছোট ছোট ব্যপার ত্যাগ করতে পারে, তাকে আমি একটু একটু করে বিশ্বাস করার চেষ্টা করি।
সম্পর্কের মূল ভিত্তিটা আসলে বিশ্বাস। কেউ আমাকে বিশ্বাস করে আমার সাথে আছে, এটাকে বলা হয় অন্ধ বিশ্বাস। আর আমি কারো বিশ্বাস অর্জন করেছি বলে, সে আমার সাথে আছে, এটাকে বলা হয় লজিক্যাল ট্রাস্ট।
লজিক্যাল ট্রাস্ট ব্যপারটার স্থায়িত্ব অনেক। এর পিলার গুলো মজবুত। এই বিশ্বাসের দেয়াল হুটহাট কম্পনে ভেঙে যায়না। প্রচন্ড জীবনের ঝড়ে এই বিশ্বাস আরো ডিউরেবল হয়ে উঠে। এর অবকাঠামো সময়ের সাথে সাথে যত পুরাতন হয়, ততো টেকসই হয়।
আমাকে কেউ বিশ্বাস করে, এই বাক্যটা শুনার পর আমি তাকে বলি, সময় নাও!
পৃথিবীর সমস্তকিছুতেই সময় নেওয়া জরুরী। সময়কে আমি বলি মেডিসিন। এই ঔষুধ একবার গিলে ফেলতে পারলে অনেক জটিল অসুখের আরোগ্য লাভ করা সহজ হয়ে যায়।
খুব ব্যথা ব্যথা যে লাগে মাঝরাতে, ওসব লাগেনা আর একসময়। লাগে হয়তো, অত'টা লাগেনা। আমার এক প্রেমিকা ছিল, প্রেমিকা মানে যেন তেন প্রেমিকা নয়। একদম বুলেটের মতো বুকে ঢুকে যাওয়া টাইপ প্রেম। আমাদের বিচ্ছেদের বেশ কিছুদিন পর এক ভোর রাতে ফোন দিয়ে সে কি জন্মের কান্নাটাই না কেঁদেছিলো। ওই কান্নায় হৃদয় ভাঙার শব্দ পাওয়া যেত। বিশ্বাসের দেয়ালে ঘেরা কল্পনার সংসার তছনছ হওয়ার চিৎকার শোনা যেত।
এরপর অনেক বছর কেটেছে। কত ফাল্গুন কেটে গেছে ঘ্রানহীনতায়। কত বসন্ত এসে চলে গেছে নিজস্ব নিয়মে। কত মানুষ আঙুল ধরে ছেড়ে গেছে ব্যক্তিগত পথে। কত নির্মানাধীন ছাদের উপর জোসনা ছড়িয়েছে মানবিক চাঁদ।
আমাদের আর যোগাযোগ হয়নি। শুনেছি দিব্যি সংসার করছে আমার মানুষ। অনিদ্রার রাত কেটে সে নিদ্রা খুঁজে নতুন বুকে।
আঙুল ছেড়ে যাওয়ার ব্যথায় আর্তনাদ করা আমার সেই নিজের মানুষ এখনো মাঝরাতে আর্তনাদ করে উঠে একটি সফল সঙ্গম শেষে, আনন্দে!
এই তো জীবন। এভাবেই সব বদলে দেয় সময়। সময়ের মতো এত বড় মানবিক চিকিৎসক আর কিছু হয়না।
বিশ্বাস করার জন্য সময় নাও। একটা মানুষের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত একেকটা ইটের মতো। যে ইট একসময় জমতে জমতে একটা বিশ্বাসের অট্টালিকা বানিয়ে ফেলে।
সময়ের বিনিয়োগ যত হয়, বিশ্বাসের দেয়ালের অবকাঠামো ততোটাই মজবুত হয়ে যায়। দুদিনেই যে তোমাকে বিশ্বাস করে মরে যেতে চায়, তার এখনো প্রকৃত জন্ম হয়নি।
তাকে ম্যাচিউর হতে বলো।

Comments

Popular posts from this blog