আমি প্রচন্ড আশাবাদী মানুষ! টুকটাক ব্যথাতে জীবনের কাছে মাথা নত করিনা কখনো। সামান্য না পাওয়াতে আমার প্রথমেই মনে হয়, এই না পাওয়ার গল্পটার প্রভাব একটা ছোট্ট সময়ের পরিসর জুড়ে। এই ছোট্ট সময়ের অপ্রাপ্তিকে আঁকরে ধরে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ছিটেফোটাও নষ্ট করার দলে কিছুতেই ঢুকে যাওয়া যাবেনা।
জীবন এবং বেঁচে থাকার আনন্দের কাছে সাময়িক দুঃখ কষ্টকে এত'টাই নগন্য লাগে যে, ওসব আমাকে গ্রাস করা তো দূরে থাক, স্পর্শ করার সাহসটুকুও পায়না।
হতাশা যে একেবারেই ছুঁতে পারেনা, তা নয়! জীবন নামক বেঁচে থাকার এই যুদ্ধে হতাশা আসবেই। তবে, এসব শত্রু শত্রু টাইপের হতাশাকে মোকাবেলা করতে হলে নিজেকে সিপাহীর মতো বেয়নেট নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয় নিজের পাশে!
একটা গল্প আমার জীবনে খুব দাগ কেটেছিলো একদিন। একজন বাবার মুখে শুনেছিলাম সন্তানের গল্প। বিয়ের প্রায় ১৪ বছর পর তাদের ঘরে একটা মেয়ে সন্তান জন্ম নিলো। এত বছর পর সন্তান হওয়ার আনন্দটা কোন ভাষাতেই বুঝানো সম্ভব না, যদি না এটা নিজের জীবনে ঘটে। এই ১৪ বছর তার ঘরে সবকিছুই ছিল। বসার সোফা, শোবার খাট, খাবার টেবিল, সেগুন কাঠের আলমারি, আরো কত কি। শুধু ঘর জুড়ে হামাগুরি দিয়ে হেটে হেটে হইহুল্লোড় করার মতো নিজের একটা সন্তান ছিলনা। এসব অসময় কেটে গিয়ে তাদের ঘরে একটা সন্তান এসেছিলো। শূন্য ঘরটা আস্তে আস্তে বসবাসযোগ্য হয়ে উঠেছিলো একটা শিশুর ক্রন্দনে। পুরুষ মানুষ বাবা হওয়ার পর দায়িত্ব নিতে শিখে যায়। পিতা হওয়ার আগে পুরুষ মানুষ ম্যাচিউর হয় ঠিকই, তবে দায়িত্বের ব্যপারটা অত'টা বুঝে উঠতে পারেনা।
তার মেয়ের বয়স যখন ৫ বছর, তখন সে হাটতে শিখে গ্যাছে। কথা বলতে শিখে গ্যাছে। দাঁতের ফাকা দিয়ে এবরো থেবরো ভাবে বাবা বলে ডাক দিলে, পুরুষ মানুষের চোখে জল আসে। এত আরাধনার যে সন্তান, সে সন্তানের মুখে বাবা ডাক শোনার আনন্দ পৃথিবীর সকল আনন্দকে হার মানিয়ে দিতে সক্ষম।
একদিন এক দুপুরবেলায়, বাবা তার সন্তানকে নিয়ে পুকুর পাড়ে গিয়েছিলো। মেয়েকে পাকা ঘাঁটে দাঁড় করিয়ে বাবা সাঁতার কাটতে কাটতে পুকুরের ওপাড়ে চলে যায়। ওপাড়ে গিয়ে যখন এপাড়ে তাকালো, তখন দ্যাখলো পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে তার আদরের সন্তান। সাঁতার কেটে এপাড়ে আসতে আসতে মেয়ে তার নিথর হয়ে গ্যাছে। বাবা তার নিজের ভালোবাসার সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে আর্তনাদ করতে লাগলো "আহারে আমার জাদুরে! আহারে আমার সোনারে! আমার মা রে!"
জলজ্যান্ত সন্তান নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া পিতা ঘরে ফিরে এসেছে লাশ নিয়ে! নিজের সন্তানের লাশ! এই গল্পটা সত্যি। আমি গল্পটা শুনেছিলাম সেই বাবার মুখেই, যার সন্তান চলে গিয়েছিলো নিজের একটু অসতর্কতায়! গল্পটা বলার সময় তার চোখ ভিজে উঠেছিলো জলে! এই জল, ভালোবাসা এবং সংসার হারিয়ে ফেলার জল! সংসার মানে স্বামী স্ত্রীর পাশাপাশি শুয়ে থাকা না, সংসার অনেক কিছু মিলে তৈরী হয়।
এই গল্পটা শুনার পর আমার নিজেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো কই জীবনে তো এখনো কিছুই হারাইনি। হারানোর আরো কত মর্মান্তিক গল্প মানুষের থাকে। আমি বড়জোর হারিয়েছি প্রেমিকা। আমি বড়জোর হারিয়েছি চাকরি। আমি খুব বেশি হলে হারিয়েছি সামান্য কিছু সুযোগ। এই তো, নাকি? অথচ, মানুষ কত কিছু হারিয়ে ফেলে জীবনে। যে হারানোর জায়গাটা আর কিছুতেই রিপ্লেস হয়না।
আমি কোন কিছু হারানোতেই ভয় পাইনা। শুধু একটু একটু ভয় পাই বিশ্বাস হারানোতে। বিশ্বাস ব্যপারটা একটু একটু করে নিজের ভেতর গড়ে তোলার পর সে বিশ্বাসকে ভাংতে দিতে ইচ্ছে হয়না।
এটা বোধয় সবার ক্ষেত্রেই হয়! মানুষ ইচ্ছে করে হলেও বিশ্বাস এবং আস্থার জায়গা গুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। এই তো কত কত প্রেমের সম্পর্কে দেখি, প্রচন্ড বড় বড় ভুলেরও ক্ষমা হয়ে যায়। একবার দুবার কিংবা বহুবার মানুষ তাকে ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসে, যাকে সে বিশ্বাস করে।
বিশ্বাস ব্যপারটাই অন্য সবকিছুর চেয়ে আলাদা। আলাদা মানে, এর অবকাঠামোটা টেকসই। এর খুটি গুলো শক্ত। অবিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট কারন থাকার পরও মানুষ নিজে নিজে যুক্তি দাঁড় করিয়ে একটা বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখে।
আমি সবকিছু হারালেও যতটা ব্যথা পাই, তারচেয়ে বেশি ব্যথা পাই বিন্দু বিন্দু করে জমিয়ে রাখা বিশ্বাস হারিয়ে গেলে।
আমি সবসময় বলি, আমার জীবনযাপনের প্রক্রিয়া সহজ! সহজ মানে, অত'টা ক্রিটিক্যাল না। যে কেউ এসে পড়তে চাইলে পড়তে পারবে। আমি আমার জীবনকে কঠিন বানিয়ে রাখিনি কখনো। আসতে চাইলে আসো, যেতে চাইলে যাও। আমার পক্ষ থেকে বাঁধা নেই কোন। অনেকে বলে, কাছের মানুষকে আটকে রাখতে হয়, কাছের মানুষকে আগলে রাখতে হয়। আমি বলি, কাছের মানুষকে মুক্ত করে দিতে হয়, স্বাধীনতা দিতে হয়। যেতে চাইলে তার সাথে থাকতে হবে কেন? থাকতে না চাইলে আটকাবো কেন? আর যে যেতেই চায়, যে স্বাধীনতাই চায়, যে মুক্তই হতে চায়, সে কাছের মানুষ হয় কি করে?
যে কাছের মানুষ, সে হবে বিড়ালের মতো! একটু উষ্ণতা পেলেই কোলে লেগে থাকবে!
জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব করতে গেলে, পাওয়ার হিসেবটা মাথা থেকে ইরেজ হয়ে, না পাওয়ার হিসেবরা সচেতন হয়ে উঠে! না পাওয়ার হিসেবরা একবার বুকের ভেতর জেগে উঠলে এদের আর ঘুম পাড়ানো যায়না। এরা চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। এরা অশান্তি দিতে থাকে। এরা ডিপ্রেশড করে তোলে। না পাওয়া নিয়ে আমার অশান্তি কম। আমি গুনে রাখি কত কিছু পেয়েছি। যতটুকু হারিয়েছি, সেসব পাওয়ার প্রতিশ্রুতি কেউ তো আমাকে দিয়ে যায়নি। জীবনের কাছে আমার কিছুই পাওয়ার নেই, সবটাই হারানোর। যেটুকু পেয়ে যাই অগোচরে, সেটুকুই তো বোনাস!
ভালো থাকার একটা সহজ পদ্ধতি হলো, আশেপাশের না পাওয়ার গল্পকে মনোযোগ দিয়ে পাঠ করতে হবে। নিজের জীবনের বাইরের জীবন যখন মানুষ পাঠ করতে শিখে যায়, তখন তার নিজের জীবন সহজ হতে শুরু করে।
কি হারালাম, তারচেয়ে বড় হলো কত কিছু পেয়ে গেছি জীবনে!
হারানো জিনিসকে বুকের ভেতর বাঁচিয়ে রাখতে নেই, যা আছে তাদেরকে একটা ছোট্ট চারা গাছের মতো রোজ রোজ জল এবং আলো দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে রাখতে বড় করে তোলতে হয়। এই প্রাপ্তির গাছ একবার বড় হয়ে গ্যালে, ছায়া দিবে এটাই সুনিশ্চিত!
প্রাপ্তিতে সুখী হও, অপ্রাপ্তি একটা বাসস্টপের মতন, কিছুক্ষন থামিয়ে রাখলেও আবার চলবেই। গন্তব্যের দিকে যেতে হলে চলতে হবে, হাটতে হবে, দেখতে হবে, শিখতে হবে, ভালো থাকতে জানতে হবে।
ভালো থাকো প্রাপ্তিতে! অপ্রাপ্তি; ওসব জীবনের একটা ছোট্ট অংশ, সম্পূর্ণ জীবন নয়!

Comments

Popular posts from this blog