মাঝে মাঝে অনেকে মেসেজ দেয়, "ভাইয়া আমি একজনকে খুব ভালোবাসি, কিন্তু তার সাথে ঠিকটাক বনিবনা হচ্ছেনা। আগের মতো যত্ন নেয় না। কেমন অবহেলা অবহেলা করে। সম্পর্কটা আছে কিন্তু না থাকার মতোই। এখন আমার কি করা উচিত?"
যদিও এইসব প্রশ্নে আমি খুব একটা খুশি হইনা। তবুও ভাবি, হয়তো অসহায়ত্ব নিয়েই আমাকে নক দিয়েছে। এসব কথা বলে একটা কিছু সমাধান চাইছে। আমি কোন কনসালটেন্ট না, তবে কেউ কিছু বললে তা সমাধান করে দেওয়াটা একটা দায়িত্বের মধ্যে পরে যায়।
সম্পর্ক নিয়ে ঝামেলায় আছে, এমন মানুষদের বেশিরভাগই বলে "তাকে ছাড়া বাঁচবো না। তার অবহেলাও ভালো লাগে। তাকে আমার চাই। সে যা বলবে তা ই শুনবো। সে আমার জীবনটা শেষ করে দিলো। সে একটা প্রতারক! বেঈমান! মিথ্যাবাদী!"
এদেরকে কেমন আছো জিজ্ঞেস করলে সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলবে "এই তো আছি কোনরকম! ভালোই! চলছে!" ইত্যাদি ইত্যাদি!
সম্পর্ক নিয়ে ঝামেলায় থাকা কেউ আমার কাছে কিছু সমাধান চাইলে আমি বলি, সবকিছুর আগে নিজেকে ভালোবাসুন।
এই সমাধানটা সবার পছন্দ হয়না। কেউ কেউ বলে, পারছিনা! নিজেকে ভালোবাসতে পারছিনা!
আমি বলি - নিজের জন্য বাঁচুন!
তারা বলে - তাকে ছাড়া বেঁচে থেকেই কি হবে।
তবুও প্রতিটা অসহায়ত্বের গল্পে আমার একটাই সমাধান থাকে, নিজেকে ভালোবাসুন।
"নিজেকে ভালোবাসুন" সমাধান পাওয়ার বেশ কিছুদিন পর এক মেয়ে মেসেজ দিয়ে বললো- আচ্ছা ভাইয়া, নিজেকে কিভাবে ভালোবাসবো?
এরকম প্রশ্নে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। মানুষ তার নিজেকে ভালোবাসার উপায়টাও আরেকজনের কাছে জানতে চায়! হায় ঈশ্বর!
আজকাল লেখালেখি তেমন করিনা। ব্যক্তিগত ব্যস্ততা এবং ফেসবুক থেকে আসক্তিটা কিছুটা কমানোর জন্য ফেসবুকের সাথে একটা দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছি। আমি ঠিক কতদিন ধরে প্রাক্তন প্রেমিকা নিয়ে ট্রল করা টাইপ স্ট্যাটাস দিই না, সেটা মনে করতে পারছিনা। একসময় মানুষকে হাসাতে ভালো লাগতো। আনন্দ দিতে ভালো লাগতো। হাহা রিয়্যাক্ট পেতে ভালো লাগতো। লাগতো মানে যে এখন আর লাগেনা, তা নয়! এখনো লাগে, তবুও নিজেকে এই ভার্চুয়াল থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছি। ফেসবুক একটা নেশার মতো হয়ে গেছে। আমি নেশা থেকে বের হয়ে আসতে চাই। সেটা ফেসবুক কিংবা মানুষ যেটাই হোক না কেন। আমি যখন টের পাই, কোন কিছুর প্রতি তীব্রভাবে আসক্ত হয়ে যাচ্ছি, তখন দূরত্ব বাড়িয়ে দিই। আমি সবচেয়ে ভয় পাই মানুষের প্রতি নেশাগ্রস্থ হয়ে যাওয়াকে। এই নেশাটা ক্ষতিকর! ফেসবুক ব্যপারটা খারাপনা, তবে এর প্রতি নেশা হয়ে যাওয়াটা খারাপ।
যাইহোক, লেখালেখি কমিয়ে দিয়েছি মানে ছেড়ে দিইনি। ফেসবুক থেকে দূরে থাকবো মানে, থাকবোই না, ব্যপারটা এমন না।
কোন কিছু ভালো লাগছেনা বলে, হুটহাট ছেড়ে দিয়ে চলে আসা যায়না। মানুষের ক্ষেত্রেও একই রকম। একটা মানুষকে ভালো লাগছেনা বলে, বিনা নোটিশে চলে যাওয়া যায়না। দূরত্ব বাড়াতে হয় কৌশলে, একটু একটু করে। দূরে যাওয়া এবং ছেড়ে যাওয়া ব্যপারটা একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ব্যপার।
সে যাইহোক, ভাবছিলাম আজ লিখবো কিভাবে নিজেকে ভালোবাসা যায়।
এই লেখাটা যখন লিখছি, তখনও আমি ঠিক করিনি কিভাবে মানুষ তার নিজেকে ভালোবাসতে পারে। তবুও লিখছি।
আমি কোন আর্টিকেল পুরোপুরি মাথায় নিয়ে লিখতে বসিনা। আমি লিখি একটা শব্দকে কেন্দ্র করে। শব্দ নিয়ে খেলা করার আনন্দ আছে। পরিকল্পিত জিনিসে আমি আনন্দ পাইনা। খুব পরিকল্পনা করে কাউকে ভালোবাসা এবং হুট করে কাউকে ভালোবাসার মাঝেও একটা বিশাল পার্থক্য আছে। হুট করে হয়ে যাওয়াটাকে আস্তে আস্তে সাজিয়ে নেওয়ার মাঝে আনন্দ থাকে। কোন কিছুকে সাজিয়ে তারপর তাকে ভালোবাসাটাকে আমি ভালোবাসা বলিনা।
এই যে মানুষ মাঝে মাঝে বলে - আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো, তারপর আমি তোমার জীবনে আসবো, এটা বিজনেস। এটাতে আমার এলার্জি কাজ করে।
ভালোবাসতে হবে এমনি এমনিই। কোন কারন ছাড়াই। মানুষটা একই টি-শার্ট পরে টানা ৪ দিন দেখা করতে আসার পরও তাকে ভালোবাসতে পারাটাই ভালোবাসা। যে মধ্যবিত্ত মেয়েটাকে দেখা করতে বললে বলে ফেলে- রিক্সা ভাড়া নেই, সেই মেয়ের সততাকে ভালোবাসা যায়। সত্য বলার সাহসকে ভালোবাসা যায়। ভালোবাসতে হয় মানুষের অসহায়ত্বকে। যখন আপনি কারো ব্যক্তিগত অসহায়ত্বকে ভালোবাসতে পারবেন, তখন বিপরীত মানুষটা সারাজীবন আপনার পায়ের কাছে কুর্নিশ করে পরে থাকবে।
যাইহোক, আজকে প্রেম ভালোবাসা নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করছেনা। তবুও কোন কিছু লিখতে গেলে, প্রেম ভালোবাসা ব্যপারটা চলেই আসে। আমাদের জীবনের সাথে প্রেম ভালোবাসাটা এত'টাই জড়িয়ে আছে যে, একে অবহেলা করা যায়না। কিভাবে করা যাবে, মানুষের জীবনের একটা বিশাল অংশজুড়ে এই প্রেম ভালোবাসা থাকে।
একটা বয়সে আমরা একজন অন্যজনের কথা ভেবে ঘুমাতে পারিনা, খেতে পারিনা, পড়তে পারিনা, সময় কাটেনা। বুকের ভেতর চিকন একটা ব্যথা হয়। মানুষটার হাত ধরে বসে থাকলেও, কেমন একটা শূন্যতা কাজ করে। এই শূন্যতা অন্যরকম। মানুষ দূরে গেলে শূন্যতা হয়, কাছে আসলে তারচেয়েও বেশি শূন্যতা হয়।
এই কাছের আসার শূন্যতাটাকে আমি বলি ভয়। হারিয়ে ফেলার ভয়। দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার ভয়। আঙুল ছুটে যাওয়ার ভয়।
জীবনের এত নিবির সময় যার সাথে আমরা কাটাই, তাকে বাদ দিয়ে জীবনকে কল্পনা করা সম্ভব না।
আচ্ছা এখন আসল গল্পে যাই। যদিও এটা কোন গল্প না, এটা উপলব্ধি করার বিষয়। নিজেকে কিভাবে ভালোবাসা যায়, এর উত্তর কেউ কখনোই দিতে পারবেনা। নিজেকে নিয়ম কানুন ফলো করে ভালোবাসা যায়না। নিজের প্রতি নিজের ভালোবাসাটা এমনি এমনিই হয়ে যায়।
কিছু মানুষ থাকেনা; যারা ইগো নিয়ে বেঁচে থাকে! এই ইগোটাকে আমরা সুশীল ভাষায় বলি, ইগো প্রবলেম। আমার নিজের কাছে আমার ইগোকে কখনো প্রবলেম মনে হয়না, বরং নিজের এই ইগোটাকেই মনে হয় নিজের কাছের নিজেকে প্রায়োরিটি দেওয়া।
একটা কথা বলি, সেল্ফ লাভ ব্যপারটা আমাদের ভেতর বিল্ট ইন।
আমরা আমাদের সমস্ত জীবনে যা কিছু করি, নিজেকে ভালোবেসে করি। এই নিজেকে ভালোবাসা ব্যপারটা আমরা কখনো চিন্তা করে দেখিনা।
আচ্ছা, আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি, কেন ভালোবাসি?
এই প্রশ্নের জবাবে অনেকে হয়তো বলবে, মানুষটা ভালো থাকুক, এটা চাই। মানুষটার যত্ন নিতে চাই। মানুষটাকে কাছে কাছে রাখতে চাই। কথাগুলো শুনলে মনে হয় কি, মানুষটার জন্য আমার দরদ উপচে পরছে। আসলে, দরদটা আমার নিজের জন্য।
আমরা যাকে ভালোবাসি, তাকে তার জন্য ভালোবাসিনা। আমরা তাকে চাই, তার জন্য চাইনা। আমরা তার যত্ন নিই, তার জন্য নিই না। আমরা তার যা যা করি, সব নিজের জন্য।
আমরা কাউকে খুব ভালোবাসি মানে, আমরা আমাদের নিজেকে খুব ভালোবাসি। একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবেন, আপনি যাকে ভালোবাসেন, তাকে ভালোবাসতে আপনার ভালো লাগে। ব্যপারটা হলো "আপনার"!
আপনি চান মানুষটা আপনার সাথে সারাজীবন থাকুক, আসলে আপনি চান, সে আপনার সাথে থাকলে আপনার ভালো লাগবে।
অন্যকে ভালোবাসা মানে নিজেকে ভালোবাসা। আপনি সবাইকে ভালোবাসতে পারবেন না, আপনি তাকে ভালোবাসবেন, যাকে আপনার ভালো লাগবে। আপনি আপনার নিজের জন্য যদি তাকে ভালো না বাসতেন, তাহলে কারো কারো চলে যাওয়াতে আপনি কষ্ট পেতেন না।
অন্যকে ভালোবাসা মানে আসলে নিজেকেই ভালোবাসা।
যাদের কোন ভালোবাসার মানুষ নেই, তারা কিভাবে নিজেকে ভালোবাসতে পারবে?
তাদের জন্য আমার কিছু প্রশ্ন আছে-
কখনো নিজেকে নিজে সময় দেন?
কখনো এমন হয়েছে, নিজেকে নিজেই ট্রিট দিচ্ছেন?
কখনো এমন কি হয়, একটা কিছু কিনে নিজেকে নিজে উপহার দিয়েছেন?
কখনো নিজেকে খুঁজতে চেয়েছেন? কখনো অনুসন্ধান করে দেখেছেন, নিজের কাছে নিজেই কত'টা নিখোঁজ হয়ে আছেন?
এই যে এত মানুষ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করেন, কখনো আত্মসমালোচনা করেছেন?
আমরা আমাদের নিজেকে খুঁজতে সময় বিনিয়োগ করতে চাইনা।
আমাদের মূল্যবান সময় বিনিয়োগ হয় " এ্যাই জানিস, ওই বাড়ির রহিমের মেয়ে তো কাল রাতে ১০ টায় বাসায় ফিরছে! মেয়েটা নষ্ট হয়ে গেছে রে!"
আমি আমার প্রেমিকাকে বলেছি - আমাকে ৩ দিনের ছুটি দাও।
সে বলে- ছুটি মানে?
আমি বললাম- ছুটি মানে, ৩ দিন আমাদের কোন যোগাযোগ হবেনা!
সে বললো- কেন?
আমি জবাব দিলাম - এই ৩ দিন নিজেকে একটু সময় দিবো! নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিনা।
সে বললো- কোন ৩ দিন ছুটি চাও, বলো?
আমি মাঝে মাঝে নিজেকে সময় দিই। নিজের সাথে নিজেই কথা বলি। কোথাও একটা দেখেছিলাম, একজন অন্যজনের সাথে কথা বললে, তাকে আলোচনা বলে, আর নিজের সাথে নিজে কথা বললে সেটা হলো একালোচনা। একালোচনা মানে হলো একা একা আলোচনা। নিজের সাথে নিজেই কথা বলা।
প্রতিটা মানুষের উচিত মাঝে মাঝে অবসরে একালোচনা করা। এতে নিজের ভেতরের কথাগুলো নিজেকে শুনানো যায়।
নিজেকে ভালোবাসতে হলে, নিজেকে জানতে হবে। নিজেকে খুঁজতে হবে। নিজেকে দেখে নিজের মুগ্ধ হতে হবে। কখনো কখনো আয়নায় নিজের দিকে নিজেই তাকিয়ে বলতে হবে - ইশ, এই মানুষটা এত জোস কেন!
কিভাবে নিজেকে ভালোবাসতে হয়, এটা নিয়ে লিখতে গিয়ে বুঝলাম, এটা লিখে বুঝানো যায়না।
মানুষ তার নিজেকে সচেতন এবং অবচেতন মনে সবসময়ই ভালোবাসে।
মাঝে মাঝে কারো চলে যাওয়ার ব্যথায় মানুষ যখন ফ্যানের সাথে ঝুলে যায়, তখন ঝুলন্ত অবস্থায় শেষ শ্বাসটা নেওয়ার আগে মনে মনে বলতে থাকে "আমার কাউকে লাগবেনা, আমি বাঁচতে চাই!"
আমি বাঁচতে চাই, এই অপ্রকাশিত বাক্যটাই সেল্ফ লাভ। বেঁচে থাকার এই আনন্দকে বেঁচে থাকতে থাকতেই উপলব্ধি করতে হয়।
শোন, তোমার জীবনে বহু মানুষ আসবে! বহু মানুষ চলে যাবে! মাঝে মাঝে এসব দূরত্বকে পাত্তা না দিয়ে হাসতে হাসতে বলতে হয় "ধুর বাল,কারো চলে যাওয়াতে কিছু হয়না।
মানুষ যখন ঠকাবে, তখন তার দিকে একদলা থুথু ফেলে চলে আসা লাগেনা, চলে আসতে হয় নিরবে।
তুমি যখন বুঝতে পারবা, তুমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি নিজেকে ভালোবাসো, তখন কারো অবহেলা, দূরত্ব, বিচ্ছেদ, দুঃখ, কষ্ট কিছুই তোমাকে হারতে দিবেনা। নিজেকে ভালো তো আমরা সবাই বাসি! বুঝে অথবা না বুঝে!
বুঝে ভালোবাসলে, বেঁচে থাকা সুন্দর! না বুঝে ভালোবাসলে, উফফ জীবনটা এমন কেন আমার?
আমি নিজেকে ভালোবাসা ব্যপারটা গুছিয়ে বলতে পারিনা, তবে নিজেকে যে কত'টা ভালোবাসি এটা রোজ রোজ অনুসন্ধান করি।
অন্যের ভালোবাসা খুঁজতে খুঁজতে নিজের কাছে নিজেই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মতো এমন বিরম্বনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নাই।

Comments

Popular posts from this blog